1. »
  2. খেলার মাঠ

নারীর চাকরি : তানজিম হাসান সাকিবের ভাইরাল পোস্টটি আমাদের কী বলে

মঙ্গলবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০২:৩০ পিএম | আপডেট: মঙ্গলবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০৬:১১ পিএম

নারীর চাকরি : তানজিম হাসান সাকিবের ভাইরাল পোস্টটি আমাদের কী বলে

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকের ম্যাচেই ভারতের বিপক্ষে অসামান্য নৈপুণ্যে সাড়া ফেলে দিয়েছেন তানজিম হাসান সাকিব। 

তবে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপজয়ী এই তরুণ পেসারের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত কিছু পোস্ট নিউজফিড থেকে এখন গণমাধ্যমে খবর হয়ে সরগরম হয়ে উঠেছে। 

ভাইরাল হয়েছে তানজিম হাসান সাকিবের ভেরিফায়েড পেজে ২০২২ সালের ৯ সেপ্টেম্বরের একটি পোস্টের স্ক্রিনশট। পোস্টটি এখন অবশ্য তাঁর টাইমলাইনে নেই। ওই পোস্টের স্ক্রিনশটে লেখা আছে:

‘স্ত্রী চাকরি করলে স্বামীর হক আদায় হয় না, স্ত্রী চাকরি করলে সন্তানের হক আদায় হয় না, স্ত্রী চাকরি করলে তার কমনীয়তা নষ্ট হয়, স্ত্রী চাকরি করলে পরিবার ধ্বংস হয়, স্ত্রী চাকরি করলে পর্দা নষ্ট হয়, স্ত্রী চাকরি করলে সমাজ নষ্ট হয়।
 
‘স্ত্রীকে যেই স্বামী বলে, আমার স্ত্রীর চাকরি করার দরকার নেই। আমি যা পাই তোমাকে খাওয়াব, সে তাকে রাজরানি হয়ে আছে। এখন সে রাজরানি না হয়ে কর্মচারী হতে চায়।’

ওই পোস্টে আরও লেখা আছে, ‘আসলে স্ত্রী স্বামীর মর্যাদা বোঝেনি, স্ত্রী নিজের মর্যাদাও বোঝেনি। ঘর একটি জগৎ। অসংখ্য কাজ রয়েছে। 

আজ ছেলেদের বেকারত্বের বড় কারণ হচ্ছে, মেয়েরা এগিয়ে আসছে, ছেলেরা কোনো চাকরি পাচ্ছে না। একটি ছেলেকে চাকরি দিলে পুরো পরিবারের উপকার হয়।’

একই পোস্টের শেষে বলা হয়েছে,‘অতএব মা-বোনেরা নিজের আত্মমর্যাদা রক্ষার্থে স্বামীর আনুগত্য ও বাসায় অবস্থান করে রানির হালাতে অবস্থান করুন। 

অতএব মা-বোনেরা দুনিয়া কামাতে যেয়ে আখেরাত না হারিয়ে ঘরে অবস্থান করে স্বামী-সন্তানের খেদমত করে দুনিয়া ও আখেরাত দুটিই কামাই করতে পারবেন ইনশাআল্লাহ।’

পোস্টের শেষে একটি মাইক্রোফোনের ইমোটিকনসহ শায়খ আবু বকর মুহাম্মাদ জাকারিয়া (হাফিযাহুল্লাহ) নামটি লেখা আছে।

মাত্র ২০ বছর বয়সী এই ক্রিকেটারের এই পোস্টের পক্ষে-বিপক্ষে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা গেছে তীব্র প্রতিক্রিয়া। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অনেকটা বিভক্ত হয়ে পড়েছে এই পোস্টকে ঘিরে।

বলা দরকার যে ধর্মের প্রতি অনুরাগ অস্বাভাবিক বা অন্যায় নয়, বরং এ মানুষের এক স্বাভাবিক ঘটনা।

তবে এই পোস্টে প্রতিফলিত হয়েছে একধরনের বিদ্বেষ— সোজা কথায়, নারীকে অধস্তন করার মানসিকতা।

কিন্তু এই ক্রিকেটারের পেজ থেকে ভাইরাল হওয়া পোস্টটি বেশ কিছু প্রশ্নেরও জন্ম দিয়েছে। সদ্য তরুণ এই প্রতিভাধর ক্রিকেটার, যাঁর মধ্যে তারুণ্যের আইকন হয়ে ওঠার সব লক্ষণ রয়েছে, আদতে তিনি কোন পথে হাঁটছেন?

প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমরা এখন ভিন্ন এক প্রেক্ষাপটে দৃষ্টি দিতে পারি।

ইংরেজিতে একটি শব্দ আছে ‘গ্রুমিং’। সাদাসিধে ভাষায় যার বাংলা করলে দাঁড়ায়, কোনো একটি বিশেষ উদ্দেশ্যের জন্য গড়েপিটে নেওয়া বা প্রস্তুত করা। 

তবে ‘গ্রুমিং’ শব্দটি আরও একটি অর্থ প্রকাশে ব্যবহৃত হয়, যখন কেউ একজন শিশু বা অপ্রাপ্তবয়স্ক বা অনভিজ্ঞ ব্যক্তির সঙ্গে আস্থা ও অনুভূতির আদান-প্রদানের মাধ্যমে সম্পর্ক গড়ে তোলে, যাতে তাদের নিয়ন্ত্রণ, স্বার্থ হাসিলে ব্যবহার ও নির্যাতন করা সম্ভব হয়, তখন তাকে ‘গ্রুমিং’ বলা হয়। 

গ্রুমিংয়ের মাধ্যমে যৌনস্বার্থ চরিতার্থ বা সন্ত্রাসী ও উগ্রবাদী কর্মকাণ্ডে যুক্ত করার অনেক নজির আমাদের সামনে রয়েছে এবং এ বিষয়ে বিভিন্ন দেশে নানা ধরনের সতর্কতামূলক ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়ে থাকে।

আমাদের এই তরুণ ক্রিকেটারও কি তেমন কোনো গ্রুমিংয়ের শিকার? শুধু কি তিনিই এমন গ্রুমিংয়ের খপ্পরে পড়েছেন, নাকি তাঁর বয়সী আরও অনেকেই এখন এ ধরনের গ্রুমিংয়ের বেড়াজালে আবদ্ধ? 

পরিস্থিতি যদি এমনই হয়ে থাকে, তবে এই তরুণদের সচেতন করতে আমরা কী করতে পারি?

শিশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা রোধে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সেবা সংস্থা এনএসপিসিসি বলছে, গ্রুমার যে-কেউ হতে পারে—অচেনা ব্যক্তি, পরিবারের সদস্য, ধর্মগুরু, প্রশিক্ষক। কয়েক সপ্তাহ থেকে বছরের পর বছর ধরে এমন গ্রুমিং করা হতে পারে। 

তবে গ্রুমার যাকে টার্গেট করেছে, তার জীবনে সে অবশ্যই কর্তৃত্বের জায়গা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করবে। এমনকি তার পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গেও সম্পর্ক গড়ে তুলবে, যাতে সে বিশ্বাস অর্জন করতে পারে।

গ্রুমারের সঙ্গে সম্পর্ক বিভিন্ন ধরনের হতে পারে, যেমন—
ক. প্রেমের সম্পর্ক

খ. গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক 

গ. কর্তৃত্বসুলভ সম্পর্ক

ঘ. প্রতিপালনসুলভ সম্পর্ক

তবে প্রতিটি ক্ষেত্রেই গোপনীয়তা ও আনুগত্য বড় ভূমিকা পালন করবে। সাধারণত গ্রুমার টার্গেট করা ব্যক্তিকে ধীরে ধীরে নিজস্ব মতাদর্শ বা ভাবধারায় অনুসারী করে তুলবে। 

তাকে নিজের সহজাত পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিজের ওপর নির্ভরশীল করে তুলবে এবং এই প্রক্রিয়াকে স্বাভাবিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে। 

ফলে যাকে গ্রুমিং করা হয়েছে, সে টেরও পাবে না কী ঘটছে তার সঙ্গে। সে বরং আনুগত্য, ভালোবাসা ও স্বীকৃত বোধ করবে।

একই সঙ্গে ভয়, লজ্জা ও অপরাধবোধকে হাতিয়ার করে গ্রুমার তাকে দিয়ে নানান কিছু করিয়ে নেবে।

আমাদের এই তরুণ ক্রিকেটারও কি তেমন কোনো গ্রুমিংয়ের শিকার? শুধু কি তিনিই এমন গ্রুমিংয়ের খপ্পরে পড়েছেন, নাকি তাঁর বয়সী আরও অনেকেই এখন এ ধরনের গ্রুমিংয়ের বেড়াজালে আবদ্ধ? 

পরিস্থিতি যদি এমনই হয়ে থাকে, তবে এই তরুণদের সচেতন করতে আমরা কী করতে পারি? বস্তুত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এই সময়ে অনলাইন-গ্রুমিং খুবই সহজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

অপনি খুব সচেতন না হলে এর ধাক্কা এড়ানো কঠিন। আর বাস্তবতার সঙ্গে পরিচয় ঘটেনি, এমন শিশু-কিশোর, তরুণদের প্রভাবিত করা একজন পরিপক্ব ও বুদ্ধিমান ব্যক্তির জন্য অনেকটা খেলার মতোই। 

আর এভাবেই বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ছড়িয়ে দেওয়া এখন আমাদের খুবই স্বাভাবিক চর্চায় পরিণত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে এমন হয় যে আমরা ঠিক বুঝে উঠতেই পারি না, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট, মতামত ও মন্তব্যের মধ্য দিয়ে আমরা কীভাবে বিদ্বেষ উৎপন্ন করছি।

মানবসভ্যতার অনেকগুলো ধাপ পেরিয়ে আমরা যখন ক্রমে সমতার পথে হাঁটছি, তখন এ ধরনের বিদ্বেষের চর্চা আমাদের সামানে না এগিয়ে দিয়ে বরং পিছিয়ে দিতে পারে।