তারেক রহমানের নতুন রাজনীতির প্রতিশ্রুতি
শুক্রবার, ১০ অক্টোবর, ২০২৫ ০৪:৪১ পিএম | আপডেট: শুক্রবার, ১০ অক্টোবর, ২০২৫ ০৪:৪১ পিএম

বাংলাদেশের রাজনীতিতে তারেক রহমানের আবির্ভাব শুধু একজন নেতার উত্থান নয়-এটি শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আদর্শিক উত্তরাধিকার ও বেগম খালেদা জিয়ার সংগ্রামী নেতৃত্বের এক জীবন্ত ধারাবাহিকতা। পারিবারিক ঐতিহ্যের মহিমা, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনৈতিক চিন্তা এবং নবপ্রজন্মের নেতৃত্বের মেলবন্ধনে তিনি হয়ে উঠেছেন বিএনপির পুনর্জাগরণের প্রতীক-এক জীবন্ত অধ্যায়; যিনি প্রমাণ করেন, তারেক রহমান কেবল ইতিহাসের অংশ নন, তিনি আজও জীবন্ত এক প্রেরণা।
১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) সদস্য নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন তারেক রহমান। ১৯৯১ সালে দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর ধীরে ধীরে দলের কার্যক্রমে সক্রিয় হন। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে দলের আদর্শ ছড়িয়ে দেওয়া, দলকে আধুনিক ও সময়োপযোগী করার প্রচেষ্টা-এসবই তাঁর রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির পরিচয় দেয়।
১৯৯৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপির কার্যক্রমে যুক্ত হয়ে তৃণমূল পর্যায়ে নেতৃত্ব বিকাশ, সংগঠন পুনর্গঠন এবং নীতিনির্ধারণে তরুণদের সম্পৃক্ত করার মধ্য দিয়ে তিনি সক্রিয় নেতৃত্বের সূচনা করেন। ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে তাঁর কৌশলগত পরিকল্পনা দলের বিজয়ের অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
২০০২ সালে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর তৃণমূল পর্যায়ে দল পুনর্গঠন শুরু করলে বিরোধী শক্তি আতঙ্কিত হয়। সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদী প্রভাবশালী শক্তি তখন তাঁর বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা, মিথ্যা মামলা ও মিডিয়া অপপ্রচারের মাধ্যমে ষড়যন্ত্র চালায়।
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি তৎকালীন সেনাপ্রধান মইন উদ্দিনের নিয়ন্ত্রণে এক অঘোষিত অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। ৭ মার্চ ভোরে কোনো মামলা বা অভিযোগ ছাড়াই তারেক রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডে নির্মম নির্যাতন-২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রায় ১৮ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ, ইলেকট্রিক শক, হাত বেঁধে ঝুলিয়ে পেটানো এবং উঁচু স্থান থেকে নিক্ষেপের ফলে মেরুদণ্ডের ৩৩টি হাড়ের মধ্যে দুটি ভেঙে যায়, স্কন্ধের হাড় ফ্র্যাকচার এবং হাঁটুর লিগামেন্ট ছিঁড়ে যায়। দীর্ঘদিন হাসপাতালে অসাড় অবস্থায় থাকতে হয়। ৫৫৪ দিন কারাবাসের পর, জামিন পেয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্য যেতে বাধ্য হন তিনি।
ফখরুদ্দীন-মইন উদ্দিনের ছদ্মবেসামরিক সরকার শুধু তারেক রহমানকেই নয়, তাঁর মা বেগম খালেদা জিয়া এবং ছোট ভাই আরাফাত রহমান কোকোকেও কারাগারে পাঠায়। কোকো ছিলেন অরাজনৈতিক ও নিরীহ প্রকৃতির। তবু তাঁকে মিথ্যা মামলায় অভিযুক্ত করা হয়। পরিবারের ওপর চাপ ও প্রিয়জনদের নির্যাতন কোকোর কোমলহৃদয় ভেঙে দেয়। শেষ পর্যন্ত ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি মালয়েশিয়ায় প্রবাসজীবনের নিঃসঙ্গ কষ্টে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। কোকোর মৃত্যু, নিজে মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত হয়ে কষ্টের প্রবাসজীবন,পরবর্তী সময়ে চক্রান্ত করে শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় এসে শহীদ জিয়ার ক্যান্টনমেন্টের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি থেকে উচ্ছেদ এবং পরবর্তী সময়ে তাঁর মাকে কারাগারে পাঠিয়ে মৃত্যুমুখে পতিত করায় জিয়া পরিবারের পারিবারিক জীবন একেবারে ধ্বংস করে দেওয়া হয়।
২০০৮ সালে চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যান তারেক রহমান। দেশের রাজনীতি থেকে কখনো তিনি সরে যাননি। দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। গত ১৭ বছর তিনি শুধু দল টিকিয়ে রাখেননি, বরং শক্তিশালী করেছেন। অবৈধ শেখ হাসিনা সরকারের নানা ষড়যন্ত্রের মধ্যেও দলকে একীভূত রাখা তাঁর নেতৃত্বের সবচেয়ে বড় প্রমাণ। প্রযুক্তির সাহায্যে ভিডিও কলের মাধ্যমে প্রতিদিন দল পরিচালনা করছেন তিনি। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে তারেক রহমান এখন দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের কেন্দ্রবিন্দু। তিনি দলের পুনর্গঠন, রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণ এবং গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ধারাবাহিক দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন।
তাঁর নেতৃত্বে বিএনপি নতুন প্রজন্মনির্ভর সংগঠনকাঠামো গড়ে তুলেছে, যেখানে প্রযুক্তি, গবেষণা এবং তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। দলের নীতিনির্ধারণে তিনি গুরুত্ব দেন-সংগঠন বিকেন্দ্রীকরণ, তরুণ ও পেশাজীবী নেতৃত্বের অংশগ্রহণ এবং জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধিতে। দীর্ঘ নির্বাসনেও তারেক রহমানের নেতৃত্ব বিএনপির প্রেরণার প্রতীক। দেশের ভিতর ও প্রবাসে নেতা-কর্মীরা আজও তাঁর বক্তব্য, দিকনির্দেশনা এবং দূরদর্শিতার ভিত্তিতে রাজনৈতিক কর্মপন্থা নির্ধারণ করছেন।
তারেক রহমানের নেতৃত্বগুণ আজ শুধু বিএনপি বা বাংলাদেশের রাজনীতিতেই নয়, বরং আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ব্যাপকভাবে স্বীকৃত ও প্রশংসিত। তিনি একাধারে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনীতিক, সংগঠক এবং নীতিনিষ্ঠ নেতৃত্বের প্রতীক। তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, দেশপ্রেম ও কর্মনিষ্ঠা এমন এক আস্থা সৃষ্টি করেছে, সর্বস্তরের মানুষ দল-মতনির্বিশেষে তাঁর হাতেই দেশের নিরাপদ ভবিষ্যৎ দেখতে পান। রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তাঁর যোগ্যতা আজ একটি অনিবার্য বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে।
আন্তর্জাতিক মহলেও তাঁর অবস্থান দিনদিন সুদৃঢ় করতে সমর্থ হয়েছেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলন ও আলোচনায় তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়, যা তাঁর বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ। তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত নেতৃত্ব, রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ও ভারসাম্যপূর্ণ বক্তব্য তাঁকে বিদেশি গণমাধ্যমেরও আগ্রহের কেন্দ্রে পরিণত করেছে।
সম্প্রতি বিবিসি বাংলা, যা বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী গণমাধ্যম। তারেক রহমানকে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য আমন্ত্রণ জানায়। দুই পর্বে সম্প্রচারিত সেই সাক্ষাৎকার রাজনৈতিক মহলে গভীর আলোড়ন সৃষ্টি করে। বিবিসির উদ্ধৃতি দিয়ে দেশের প্রায় সব সংবাদপত্র ও অনলাইন প্ল্যাটফর্ম সাক্ষাৎকারের মূল বক্তব্যগুলো গুরুত্বসহকারে প্রচার করে। এতে প্রমাণিত হয়, তারেক রহমান আজ কেবল একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নন-তিনি জাতীয় নেতৃত্বের আশার প্রতীক, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের এক মর্যাদাবান মুখ এবং বাংলাদেশের আগামীর প্রধানমন্ত্রী।
৬ অক্টোবর প্রথম পর্ব এবং ৭ অক্টোবর দ্বিতীয় পর্বে বিবিসি বাংলার সঙ্গে তিনি একটি গভীর ও বিস্তৃত সাক্ষাৎকার প্রদান করেন। দুই পর্বে দেশের রাজনৈতিক পরিসর, দলের বর্তমান অবস্থা এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে তাঁর বক্তব্য প্রকাশ পেয়েছে; যা দেশের রাজনীতিকে নতুন আলোতে ভাবতে এবং প্রতিটি নাগরিককে সচেতন ও অংশগ্রহণমূলক রাজনীতির আহ্বান জানাচ্ছে। নিচে সংক্ষিপ্ত আকারে সাক্ষাৎকারের মূল বিষয়গুলো তুলে ধরা হলো :
৬ অক্টোবর বিবিসি বাংলাকে দেওয়া তাঁর প্রথম পর্বের সাক্ষাৎকারে তারেক রহমান বলেছেন, ‘আমি দেশে ফেরার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। তবে আমি যদি এখন বলি-কাল বা পরশু ফিরছি, সেটা দায়িত্বশীল কথা হবে না।’ তাঁর এই সংযত মন্তব্যে ফুটে উঠেছে অভিজ্ঞ রাজনীতিকের কৌশল, ধৈর্য ও পরিপক্বতা।
জুলাইয়ের গণ অভ্যুত্থান ও শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর যে নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি হয়েছে, তাতে বিএনপি আবারও জনআস্থার কেন্দ্রে ফিরে এসেছে। তারেক রহমান স্পষ্ট করে বলেন, ‘জনগণ আওয়ামী লীগের একদলীয় শাসনের অবসান ঘটিয়েছে। বিএনপির প্রতি এখন নতুন করে আস্থা ফিরেছে। সেই আস্থাকে কার্যকর রাজনীতিতে রূপ দিতে আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি।’
তিনি জানান, এখন দলের পুনর্গঠন, সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি এবং নেতৃত্বের প্রজন্মান্তরের কাজই অগ্রাধিকার পাচ্ছে। তাঁর নেতৃত্বে বিএনপিতে নতুন প্রজন্মের অংশগ্রহণ বেড়েছে; তরুণ নেতৃত্ব গড়ে উঠছে নীতিনিষ্ঠ, প্রযুক্তিসচেতন ও আধুনিক রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে। বেগম খালেদা জিয়ার প্রসঙ্গে তারেক রহমানের কণ্ঠে ছিল গভীর শ্রদ্ধা ও আবেগ।
তিনি বলেন, ‘আমার মা শুধু একজন নেত্রী নন, বাংলাদেশের গণতন্ত্রের প্রতীক।’ তাঁর এই বক্তব্যে প্রতিফলিত হয়, বিএনপি এখনো সেই গণতান্ত্রিক আদর্শ ও সংগ্রামের পথেই অটল, যে পথে বেগম খালেদা জিয়া একসময় জাতিকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
নির্বাচন প্রসঙ্গে তারেক রহমান স্পষ্ট ভাষায় বলেন, বিএনপি কখনো নির্বাচনের বিরোধী নয়, তবে ‘ভুয়া ও প্রহসনের নির্বাচন’ মেনে নেওয়া যাবে না। তাঁর এই বক্তব্যে ফুটে ওঠে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিগত অবস্থান-যেখানে সুষ্ঠু ভোট, নিরপেক্ষ প্রশাসন ও জনগণের অংশগ্রহণই মূল শর্ত।
প্রবাসে বসে রাজনীতি করার সমালোচনার জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি প্রবাসে আছি নিরাপত্তাজনিত কারণে, পালিয়ে নয়। আমি প্রতিদিন দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি, প্রতিটি কার্যক্রমে যুক্ত আছি।’ এই বক্তব্য যেন তাঁর রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার প্রমাণ-দূরত্ব থাকলেও তিনি দলের কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন, এবং বিএনপির দিকনির্দেশনা এখনো তাঁর হাতেই নির্ধারিত হয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই সাক্ষাৎকারে তারেক রহমানের কণ্ঠে যে আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ়তা শোনা গেছে, তা তাঁর দীর্ঘ প্রস্তুতি ও রাজনৈতিক পরিণতি পূর্ণতারই প্রতিফলন। তিনি দেশে ফেরার সময় নির্দিষ্ট না করলেও তাঁর বক্তব্যে স্পষ্ট সময় তিনি বেছে নেবেন, কিন্তু নেতৃত্বের শূন্যতা তিনি রাখবেন না।
প্রায় দেড় যুগ ধরে প্রবাসে থেকেও তিনি বিএনপিকে সংগঠিত রেখেছেন, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের দমননীতির মধ্যে নেতা-কর্মীদের সাহস জুগিয়েছেন এবং দেশব্যাপী গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আগুন জ্বালিয়ে রেখেছেন। তাঁর নেতৃত্বে বিএনপি এখন এক নতুন রূপে আত্মপ্রকাশ করছে-সংঘাত নয়, কৌশল ও সংগঠনের শক্তিতে।
তারেক রহমানের এই সাক্ষাৎকার তাই কেবল একটি বক্তব্য নয়, এটি যেন বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক দায়িত্বশীল নেতৃত্বের পুনরুত্থানের ঘোষণা। তিনি হয়তো এখনো দেশে ফেরার তারিখ জানাননি কিন্তু তাঁর প্রতিটি শব্দে, প্রতিটি ইঙ্গিতে ধ্বনিত হচ্ছে একটি বার্তা-‘আমি আসছি, প্রস্তুত হয়ে, দায়িত্ব নিয়ে, দেশের জন্য।’
পরদিন, ৭ অক্টোবর ২০২৫ বিবিসি বাংলাকে দেওয়া দ্বিতীয় পর্বের সাক্ষাৎকারে তাঁর কণ্ঠে শোনা যায় আরও গভীর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও রাষ্ট্রচিন্তার প্রতিধ্বনি। সেখানে তিনি দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা, ভবিষ্যৎ রাজনীতি ও তাঁর ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে অকপটে মতপ্রকাশ করেন।
তারেক রহমান বলেন, বিএনপি চায় অন্তর্বর্তী সরকার সফল হোক এবং তাদের দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করুক। সরকারের কাজের মানই নির্ধারণ করবে সম্পর্কের উষ্ণতা বা শীতলতা। শুরুতে সরকারের রোডম্যাপ না থাকায় সন্দেহ ছিল, কিন্তু ড. মুহাম্মদ ইউনূস রোডম্যাপ ঘোষণার পর ধীরে ধীরে আস্থা ফিরেছে।
এক-এগারোর সরকারের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সেই সরকার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও অসৎ উদ্দেশ্যে গঠিত ছিল। তারা গণতন্ত্র ধ্বংস ও বিরাজনীতিকরণের মাধ্যমে দেশকে অন্ধকারে ঠেলে দিতে চেয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা তাঁকে এবং তাঁর দলকে আরও দৃঢ় করেছে গণতন্ত্র ও জনগণের অধিকারের পক্ষে লড়াইয়ে।
তারেক রহমান মনে করেন, বিএনপির রাজনীতি জনগণ, দেশ ও সার্বভৌমত্বকেন্দ্রিক। তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, বাংলাদেশের গার্মেন্টশিল্প, প্রবাসী আয় ও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার যাত্রা শুরু হয়েছিল বিএনপি আমলেই। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হাত ধরেই দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। ভবিষ্যতে বিএনপি চায় এমন এক রাষ্ট্রব্যবস্থা, যেখানে গণতন্ত্র, জবাবদিহি ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে।
প্রবাস জীবনের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ১৭ বছরের নির্বাসন তাঁকে নতুন বাস্তবতা শিখিয়েছে। পরিবার ও দলের সহযোদ্ধাদের ত্যাগ তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছে। লন্ডনে বসবাস তাঁকে দেখিয়েছে কীভাবে রাষ্ট্র ও সমাজ একে অপরের সম্পূরক হতে পারে। তিনি বলেন, ‘দেশের জন্য ইতিবাচক কিছু করার সুযোগ পেলে আমি সর্বোচ্চটা দিতে চাই।’
কূটনীতি নিয়ে প্রশ্নে তারেক রহমান বলেন, ‘সবার আগে বাংলাদেশ’- এই নীতিতেই বিএনপির বৈদেশিক অবস্থান নির্ধারিত হবে। দেশের সার্বভৌমত্ব ও জনগণের স্বার্থের সঙ্গে কোনো আপস হবে না। তিনি স্পষ্টভাবে বলেন, ‘আমি বাংলাদেশি, তাই বাংলাদেশের স্বার্থই আমার কাছে সর্বোচ্চ।’
ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই আমি আমার পানির হিস্সা চাই, আর ফেলানীর মতো হত্যাকাণ্ড মেনে নেওয়া হবে না।’ তাঁর মতে, ভারত যদি বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থবিরোধী অবস্থান নেয় বা স্বৈরাচারকে আশ্রয় দেয়, তাহলে সেটির দায় জনগণই নির্ধারণ করবে, বিএনপি নয়। বিএনপি থাকবে জনগণের পাশেই। তিনি বলেন, গণতন্ত্র মানে ভিন্নমতের জায়গা থাকা। সংস্কার মানে ভিন্নমতের দমন নয়, বরং গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করা। সাংবিধানিক সংস্কারের কিছু বিষয় নির্বাচিত সংসদেই হওয়া উচিত। কারণ, জনগণের ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত প্রতিনিধিরাই জাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। সরকারে গেলে বিএনপি ৩১ দফা ও জুলাই সনদের ঐকমত্যভিত্তিক বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করবে। রাজনৈতিক অনুষ্ঠানের বাইরে পোষা বিড়ালের সঙ্গে নিয়মিত ছবি দেখা যায় প্রসঙ্গে তারেক রহমান জানান, আলোচিত বিড়ালটি তাঁর মেয়ের, তবে পুরো পরিবারেরই প্রিয়। শৈশব থেকেই তিনি প্রাণী ও প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক অনুভব করেন। তিনি বলেন, ‘আল্লাহ আমাদের সৃষ্টির সেরা করেছেন, তাই প্রকৃতি ও জীবজন্তুর যত্ন নেওয়া আমাদের দায়িত্ব।’ দেশের পরিবেশ ও বনভূমি ধ্বংসের বিষয়টি তিনি ‘অত্যন্ত উদ্বেগজনক’ বলে অভিহিত করেন এবং এর সংরক্ষণে কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজের ছবি, কার্টুন বা মিম নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তারেক রহমান হাসিমুখে বলেন, ‘আমি এগুলো এনজয় করি।’ তাঁর মতে, সামাজিক মাধ্যম আজ এক শক্তিশালী যোগাযোগমাধ্যম-এটি দায়িত্বশীলভাবে ব্যবহার করা জরুরি।
সাক্ষাৎকারের শেষ পর্যায়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের মূলনীতি একটাই, সবার আগে বাংলাদেশ।’ জনগণের স্বার্থই বিএনপির রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। তাঁর বক্তব্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠে-তিনি শুধু রাজনীতিক নন, বরং জনগণের ভাগ্যনির্ধারণে দায়বদ্ধ এক নেতা, যিনি বিশ্বাস করেন, ‘জনগণ যা চায়, বিএনপি সেটিই বাস্তবায়ন করবে।’ বিবিসি বাংলাকে দেওয়া বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারকে দেশের বিশিষ্ট আইনজীবী, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও গবেষকরা দেখছেন ‘নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির সূচনা’ হিসেবে। তাঁদের মতে, এই সাক্ষাৎকারে ফুটে উঠেছে এক পরিণত, দায়িত্বশীল ও আত্মবিশ্বাসী রাষ্ট্রনায়কের প্রতিচ্ছবি।
মাত্র কয়েকজনের প্রশংসাসূচক মন্তব্য তুলে ধরছি :
সুচিন্তিত ও দায়িত্বশীল শব্দচয়ন : অ্যাডভোকেট শিশির মনির :
বাংলাদেশের সংবিধান ও ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ অ্যাডভোকেট শিশির মনির বলেন, ‘তারেক রহমান অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে শব্দচয়ন করেছেন। প্রতিটি বাক্য ছিল পরিমিত, সতর্ক ও দায়িত্বশীল। কেউ যেন তাঁর বক্তব্য বিকৃতভাবে ব্যবহার করতে না পারে, সে বিষয়ে তিনি সচেতন ছিলেন।’
তিনি আরও মন্তব্য করেন, ‘আমি মনে করি, এটি একটি গুড স্টার্ট। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মধ্যে তিনি একজন। তাঁর এই সাক্ষাৎকার জাতির জন্য শিক্ষণীয়।’
জনগণের বিশ্বাসই তাঁর শক্তি : মাহবুব নাহিদ :
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মাহবুব নাহিদ মনে করেন, এই সাক্ষাৎকারে তারেক রহমান নিজের রাজনৈতিক দর্শনকে নতুনভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘প্রায় দুই দশক প্রবাসে থেকেও তাঁর চিন্তা, দর্শন ও ভালোবাসা বাংলাদেশের মাটির সঙ্গেই যুক্ত ছিল। তাঁর বক্তব্যে আত্মবিশ্বাস, প্রজ্ঞা ও সংযমের এক অনন্য সমন্বয় দেখা গেছে।’ তারেক রহমানের উক্তি-‘আমি মাস্টারমাইন্ড নই, এই আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী জনগণ।’ এই উদ্ধৃতিটি মাহবুব নাহিদের মতে, ‘নেতৃত্বের বিনয় ও গণবিশ্বাসের প্রতীক।’
একজন জাতীয় নেতার ভাষা এমনই হওয়া উচিত : অধ্যাপক মির্জা গালিব :
যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মির্জা গালিব বলেন, “আমার কাছে সবচেয়ে ভালো লেগেছে ফার্স্ট পারসনের অনুপস্থিতি। ‘আমি’, ‘আমার দল’ নয়- বরং তিনি বলেছেন, ‘জনগণ’, ‘দেশ’, ‘গণতন্ত্র’। একজন জাতীয় নেতার ভাষা এমনই হওয়া উচিত।” তিনি আরও যোগ করেন, ‘আওয়ামী লীগের বিচার প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য ছিল যুক্তিনির্ভর ও আবেগঘন। ব্যক্তিগত ক্ষোভ নয়, বরং সামষ্টিক ন্যায়বিচারের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি-এটাই প্রজ্ঞা ও পরিণত রাজনৈতিক মননের পরিচয়।’
তারেক রহমানের বক্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে দায়িত্বশীল রাজনীতির ভাষা, যেখানে প্রতিহিংসার জায়গা নেই; আছে ন্যায়, আইনের শাসন ও জনগণের প্রতি আস্থা। তাঁরা মনে করেন, এই সাক্ষাৎকার শুধু বিএনপির জন্য নয়; বাংলাদেশের সামগ্রিক রাজনীতির জন্যও একটি ইতিবাচক মোড় ঘোরানোর বার্তা বহন করছে। তারেক রহমান এখন আর শুধুই বিএনপির নেতা নন-তিনি হয়ে উঠছেন এক নতুন রাজনৈতিক যুগের প্রতীক, যেখানে নেতৃত্বের শক্তি নির্ভর করছে জনআস্থা, প্রজ্ঞা ও পরিমিত দায়িত্ববোধের ওপর।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, তাঁর বক্তব্য প্রতিপক্ষের কাছ থেকেও প্রশংসা পেয়েছে। তিনি জাতির প্রত্যাশার কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। নেতারা একবাক্যে বলছেন, তারেক রহমানের সাক্ষাৎকারে যেমন রয়েছে ব্যক্তিগত যন্ত্রণার মানবিক প্রকাশ, তেমনি রয়েছে রাজনৈতিক পরিপক্বতার প্রতিফলন। শেষ পর্যন্ত তাদের অভিমত-এটি শুধু একটি সাক্ষাৎকার নয়, বরং জাতীয় রাজনীতির জন্য এক রাষ্ট্রনায়কোচিত ঘোষণাপত্র।
বিবিসি বাংলার সাক্ষাৎকারে তারেক রহমান শুধু রাজনৈতিক বক্তব্যই দেননি; তিনি দেশের গণতন্ত্র ও জাতির প্রতি দায়িত্ববোধ, নেতৃত্বের সংযম ও আত্মবিশ্বাসের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। দীর্ঘ প্রবাস জীবনের পরও তিনি বিএনপিকে শক্তিশালী ও সংগঠিত রাখার মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নেতৃত্বের নবজ্যোতি ছড়িয়ে দিয়েছেন।
আজ তিনি শুধু বিএনপির নেতা নন-তিনি বাংলাদেশের নতুন রাজনৈতিক যুগের প্রতীক, যেখানে নেতৃত্বের শক্তি নির্ভর করছে জনআস্থা, নৈতিকতা, প্রজ্ঞা এবং দায়িত্ববোধের ওপর। তাঁর প্রজ্ঞাপূর্ণ নেতৃত্ব, দায়িত্বশীল ভাষা এবং মানবিক রাজনৈতিক মনন দেশের সব নেতার জন্য এক শিক্ষণীয় উদাহরণ।
লেখক : আতিকুর রহমান রুমন
সিনিয়র সাংবাদিক, আহ্বায়ক, আমরা বিএনপি পরিবার ও সদস্য, বিএনপি মিডিয়া সেল
আরও পড়ুন
- নৈতিকতার অভিজ্ঞতায় রাজনীতিক তারেক রহমান
- দুর্গাপূজা উপলক্ষে তারেক রহমানের সতর্কবার্তা
- ডাকসু-জাকসু প্রজন্মের আস্থাভঙ্গের নির্বাচন
- বাংলাদেশের অভিভাবকের আসনে বেগম খালেদা জিয়া
- আজও খুঁজে ফেরে তার চোখ কোকোকে
- মৃত্যুঞ্জয়ী মাহেরিন চৌধুরী
- বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ও কৃষির সংযোগ; প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কৃষি ভাবনা
- হাসিনা পালিয়ে দিল্লিতে, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক তলানিতে