1. »
  2. মতামত

স্থানীয় সরকারের ভোটেও কমছে ভোটারের আগ্রহ

মঙ্গলবার, ১২ মার্চ, ২০২৪ ১২:৫৯ পিএম | আপডেট: মঙ্গলবার, ১২ মার্চ, ২০২৪ ০৫:২৭ পিএম

স্থানীয় সরকারের ভোটেও কমছে ভোটারের আগ্রহ

জাতীয় নির্বাচনের মতো স্থানীয় সরকারের ভোটেও সাধারণ মানুষের তেমন কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। উল্লেখযোগ্যসংখ্যক রাজনৈতিক দলের বর্জন, দুর্বল প্রতিদ্বন্দ্বিতা, সরকারদলীয় একাধিক প্রার্থীর সমর্থকদের সহিংসতা, ভোটের মাঠে প্রভাব বিস্তার, ফলাফলে আস্থাহীনতাসহ নানা কারণে ভোটবিমুখ হয়ে পড়ছেন নাগরিকরা। ভোটারদের মধ্যে তৈরি হওয়া এই প্রবণতাকে গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত বলে মনে করেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা। এমন পরিস্থিতি উত্তরণে সরকার, নির্বাচন কমিশন ও রাজনৈতিক দলগুলোকে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

গত শনিবার ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনে সাধারণ ও কুমিল্লা সিটির উপনির্বাচনসহ স্থানীয় সরকারের ২৩১টি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে ময়মনসিংহের ৩ লাখ ৩৬ হাজার ৪৯৬ জন ভোটারের মধ্যে ১ লাখ ৮৯ হাজার ৪৩৯ জন ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। এ সিটিতে ভোট প্রদানের হার ৫৬ দশমিক ৩০ শতাংশ। তার আগে ২০১৯ সালে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ইকরামুল হক টিটু মেয়র নির্বাচিত হন।

অন্যদিকে কুমিল্লা সিটিতে ২ লাখ ৪২ হাজার ৪৫৮ ভোটারের মধ্যে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন মাত্র ৯৪ হাজার ১১৫ জন। ভোটের হার ৩৮ দশমিক ২ শতাংশ। ২০২২ সালের কুমিল্লায় ভোট পড়েছিল ৫৮ দশমিক ৬১ শতাংশ।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটের হার ছিল ৫৪ দশমিক ৯ শতাংশ। ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় জাতীয় নির্বাচনে ৫১ দশমিক ৩ শতাংশ, ১৯৮৬ সালে তৃতীয় জাতীয় নির্বাচনে ৬১ দশমিক ১ শতাংশ, ১৯৮৮ চতুর্থ জাতীয় নির্বাচনে ৫২ দশমিক ৫ শতাংশ, ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় নির্বাচনে ৫৫ দশমিক ৪ শতাংশ, ১৯৯৬ সালে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (একতরফা) ২১ শতাংশ, ১৯৯৬ সালে সপ্তম জাতীয় নির্বাচনে ৭৫ দশমিক ৬০ শতাংশ, ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় নির্বাচনে ৭৪ দশমিক ৯৭ শতাংশ, ২০০৮ সালে নবম জাতীয় নির্বাচনে ৮৭ দশমিক ১৩ শতাংশ, ২০১৪ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ৩৯ দশমিক ৫৮ শতাংশ এবং ২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনে ৮০ দশমিক ২ শতাংশ ভোট পড়ে। সরকারবিরোধীদের বর্জনের মুখে গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটের হার ছিল ৪১ দশমিক ৮ শতাংশ।

নির্বাচন সংশ্লিষ্টদের মতে, ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই ভোটবিমুখ হওয়া শুরু হয় নাগরিকদের। বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকারবিরোধীদের বর্জনের মুখে ওই বছর ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় এ নির্বাচন, যা নিয়ে দেশ-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে সরকার।

এরপর সরকার ও নির্বাচন কমিশনের নানা আশ্বাসের পর বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দল ২০১৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয়। কিন্তু ওই নির্বাচনে ভোট গ্রহণের আগের রাতে কোনো কোনো এলাকায় ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্সে ভরে রাখার অভিযোগ ওঠে। এসব কারণে ভোটারদের মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়। জাতীয় সংসদ ছাড়াও স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনেও একই চিত্র দেখা যায়। 

বিরোধীদের বর্জনের মুখে সিটি করপোরেশন, উপজেলা, পৌর ও ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল মনোনীত প্রার্থীদের শক্তি প্রদর্শন এবং অনেক জায়গায় ফলাফলে প্রভাব বিস্তারের কারণে দিন দিন আস্থাহীনতা তৈরি হচ্ছে ভোটারদের মধ্যে। গত পাঁচ বছরে স্থানীয় সরকার ও সংসদের বিভিন্ন উপনির্বাচনে ২০ শতাংশের কম ভোট পড়তেও দেখা গেছে। সরকারবিরোধীদের বর্জনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে ভোটের হার ছিল মাত্র ৪১ দশমিক ৮ শতাংশ। যদিও ভোটের এ হার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন নির্বাচনের বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন মহল।

নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, উৎসবমুখর ভোটের জন্য বড় রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ অপরিহার্য। এ ছাড়া কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীও থাকা আবশ্যক। পছন্দের দল এবং শক্ত প্রার্থী না থাকলে ভোটাররাও ভোটকেন্দ্রে যেতে চান না। ২০১৮ সালের অংশগ্রহণমূলক একাদশ জাতীয় সংসদের সঙ্গে দ্বাদশ জাতীয় সংসদের ভোটের হারের তুলনায় সেটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। শুধু তাই নয়, অতীতে জাতীয় নির্বাচনের তুলনায় স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য থাকলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে। গত শনিবার অনুষ্ঠিত দুই সিটিসহ স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের ২৩১টি নির্বাচনের চিত্রে সেটি ফুটে উঠেছে। জাতীয় নির্বাচনের মতো স্থানীয় এসব নির্বাচনও বিরোধী দলগুলো বর্জন করেছিল।

এর আগে একাদশ সংসদের গাইবান্ধা-৫ উপনির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি দেখে খানিকটা হতাশ হয় নির্বাচন কমিশন। পরে নানা অনিয়মের অভিযোগে ওই ভোট বাতিল করে সব কেন্দ্রে ফের ভোট গ্রহণ করা হয়। পরে দ্বিতীয়বার অনুষ্ঠিত হওয়া ওই নির্বাচনেও ২০ থেকে ২৫ শতাংশ ভোট পড়ে। বিগত সংসদে বিএনপি এমপিদের ছেড়ে দেওয়া ৬ আসনের উপনির্বাচনেও হতাশাজনক ভোটার উপস্থিতি নজর কাড়ে নির্বাচন সংশ্লিষ্টদের। এসব নির্বাচনেও গড়ে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে জানায় নির্বাচন কমিশন। এর আগে করোনা মহামারির মধ্যে ২০২০ সালের মার্চে ঢাকা-১০ আসনের উপনির্বাচনে ইভিএমে সবচেয়ে কম ভোট পড়ার রেকর্ড রয়েছে। ওই নির্বাচনে ভোট পড়ার হার ছিল ৫ দশমিক ২৮ শতাংশ। তারও আগে ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ইভিএমের ব্যাপক প্রচারের মধ্যে ভোটারের খরা দেখেছিল ঢাকার দুই সিটির নির্বাচনে। সেবার দক্ষিণ সিটিতে ২৯ শতাংশ ও উত্তরে ভোটের হার ছিল ২৫ দশমিক ৩ শতাংশ।